ক্যানভাস নিউজ
Image default
নৃত্য

পুতুল নাচের ইতি-কথা

অলিভিয়া: বাইরের কেউ এলে ওঁরা ছুটে আসেন। জানতে চান কলকাতা থেকে এলেন? ক্যামেরা দেখলে বলেন, টিভির লোক বুঝি? সরল প্রশ্ন, নিষ্পাপ হাসিমুখ, সহজ যাপন। ওঁরা এখনও মিলেমিশে বাঁচেন। গাঁয়ের নাম পদ্মতামলি। লোকে বলে বেণিপুতুল গ্রাম। রাস্তার পাশে সাইনবোর্ডটা এখন অস্পষ্ট। পড়া যায় না। কোনও কালে যেত হয়তো বা। বোর্ডটার মতোই ওখানকার মানুষগুলোর একটা অস্পষ্ট স্মৃতি আছে। হেলাফেলা জীবন বটে, তবু ওঁদের গ্রামটা বিখ্যাত। ওঁরাও জানেন। শহুরে বাবুরা মাঝেমধ্যে এসে ওঁদের বাইট নিয়ে যান। ছবি তোলেন। ফি বছর আলগোছে একটুখানি ফুটেজ পাওয়া।

পুতুল শিল্পি গণেশ ঘড়াই

বড় রাস্তার পাশ দিয়ে কাঁচা মাটির রাস্তা নেমে গিয়েছে। একটা পুকুর ঘিরে ছোট্ট পাড়া। কলতলায় জটলা। ঘোমটা টেনে জল আনতে এসেছেন। অনেকে খোস গল্পে মেতেছেন। আমাদের দেখে চুপ করে গেলেন। গরু-ছাগলগুলো রাস্তার পরোয়া না করে আপন মনে চরছে। কারোই তেমন তাড়া নেই। ভারী ছিমছাম একখানা গ্রাম। এই পাড়াটাতেই ওঁদের বাস। ওঁরা পুতুল নাচিয়ে।এখন অবশ্য পুতুল নাচিয়ে বলা চলে না। কেউ টোটো চালান, কেউ চাষ, কেউ আবার দিনমজুর। সময় পেলেই পুতুলের গায়ের ধুলো একটু ঝেড়ে নেওয়া। এ ভাঙাচোরা শিল্পে কি আর পেট চলে! ফুটো চাল-মাটির বাড়ি, পোয়াতি বউ, কোলের ছেলেটা, ওদের মুখ চেয়ে বাপ- ঠাকুরদার পেশা ছাড়তে হয়েছে। ক্ষয়াটে পুতুলগুলোর দিকে তাকিয়ে বুকটা হু হু করে ওঠে। মাটির দাওয়ায় বসে গল্প শোনান রবি ঘড়াই।

পদ্মতামলি গ্রাম

বাস স্ট্যান্ড থেকে ওঁর টোটোতেই এসেছি। পুতুলনাচের খোঁজে এসেছি শুনে বড় খাতির করে আনলেন বাড়িতে। মাটির ঘরে এক চিলতে দালান আর একটা শোওয়ার ঘর। পাশে একটুখানি জায়গায় রান্নাবাড়া। ওই ঘরেই আমাদের জন্য চা তৈরি হচ্ছে। দাওয়ায় ততক্ষণে আড্ডা জমে উঠেছে। গ্রামের সবাই জড়ো হয়েছেন। এই পদ্মতামলি, বাংলার হাত পুতুল বা দস্তানা পুতুলের আঁতুড়ঘর। এক সময় প্রায় একশো পরিবারের বাস ছিল। এখন মেরেকেটে পঁচিশ বাড়িতে পুতুল নাচিয়েরা আছেন। বেণিপুতুলের উৎপত্তি নিয়ে একটা গল্প চালু আছে। সত্যি কিনা জানি না। তবে ওঁরা তাই বলেন। নীলকর আমলে একদিন সেপাইয়ের ভয়ে গ্রামের সবাই জঙ্গলে গিয়ে লুকিয়েছেন। ঝোপের আড়াল থেকে এক সেপাইকে অনেকক্ষণ তাঁরা দেখতে পাচ্ছিলেন। ঠিক সামনের গাছের আড়ালে।খানিকক্ষণ কাটতে খেয়াল করলেন, সেপাই কিন্তু নড়ছেন না। এক্কেবারে স্থির। সন্দেহ হতে পা টিপে টিপে সবাই মিলে এগিয়ে গেলেন। যা দেখলেন তাতে সবার চক্ষু ছানাবড়া। এতক্ষণ যাকে সেপাই বলে ভয় পাচ্ছিলেন আসলে সেটি ছিল তালের আঁটি। তাঁরা সেই তালের আঁটি বাড়িতে এনে তাতে চোখ-মুখ খোদাই করেন। সুন্দর কাপড় পরিয়ে সেপাইকে হাতে করে ‘নাচান’। সেই গান আর নাচ ইংরেজদেরও নজরে পড়ে। তাঁরা নাকি গ্রামে এলে মুগ্ধ চোখে পুতুল নাচ দেখতেন। ততক্ষণে অবশ্য গোটা গ্রাম ফাঁকা। এভাবেই বেণিপুতুল নাচ শুরু হল।

বেণিপুতুল

শুরুর দিকে হাতে করে পুতুল নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরতেন শিল্পীরা। গ্রামবাংলার অলিতে-গলিতে ডুগডুগির আওয়াজ ভেসে আসত। ছেলে-বউরা ঘিরে ধরলে ওঁরা ঝোলা নামাতেন। দু-চার পয়সা দিলে দুই হাতে পুতুল নিয়ে নাচ গান শুরু হত।সে দিন অবশ্য গেছে। এখন আর এই মাধুকরী বৃত্তি চালু নেই। সরকারি ভাতা পান। তিন মাসে তিন হাজার। বছরে দু একটা শো। যা হয়, তাতে আর যাই হোক সংসার চলে না। তবু ওঁরা জাত শিল্পী। পেটের পরোয়া করেন না। শো হোক না হোক চর্চায় খামতি নেই। একখানা শিল্পী কার্ড পেয়েছেন। তাতেই গর্বিত হাসি। রোজগার নাই বা হল।

কথার মাঝেই আলমারির মাথা থেকে বাক্স নামিয়ে পুতুল বার করলেন। পুতুলের মাথাটা মাটির তৈরি। কিছু কিছু পুতুল আবার কাগজের মন্ড দিয়ে বানানো। তার উপর উজ্জ্বল রঙের প্রলেপ। হাতগুলো কাঠের, ঘুঙুর বাঁধা। শিল্পীরা পুতুলের হাতের মধ্যে দুটি আঙুল আর পুতুলের মাথায় ওই হাতেরই অন্য একটা আঙুল ঢুকিয়ে পুতুল নাচান। দুই হাতের তালিতে ঘুঙুর বাজে। সঙ্গতে লোকগান, ঢোলক।

ওঁরা বলছিলেন, কত জায়গায় পুতুল নাচ দেখিয়ে পয়সা পাননি। লোকজন অপমান করেছেন। কোথাও আবার চোর অপবাদও পেয়েছেন। তবু ওঁরা পুতুল নাচ ছাড়েননি। এই পুতুলটাই ওঁদের সব। এর জন্য যে কত সম্মানও পেয়েছেন!

গান ধরলেন রবি ঘড়াইরা…

“আষাঢ়ে জল নেমেছে

মাটিতে হাল পড়েছে

গিন্নি লাঙ্গল নিয়ে চল না গো চল না…

শোনো বলি ও খোকার বাপ,

লোকে যে বলবে খারাপ…

আমি লাঙল ধরিতে যাব না গো যাব না…”

বেণিপুতুলের হাত

ওঁদের মনের গভীরে অনেকটা অভিমান জমে রয়েছে। গান থামিয়ে বললেন- ‘নতুন প্রজন্মের কেউ পুতুলনাচ শিখতে চাইছে না। আর শিখবেই বা কেন! এতে না রয়েছে হকের সম্মান, না রয়েছে রোজগার। কিন্তু এই শিল্প যে গ্রাম বাংলার সম্মান, ঐতিহ্য। তা কি এভাবেই শেষ হয়ে যাবে? আমরা চলে গেলে দলটার কী হবে কে জানে!’ দীর্ঘশ্বাস আর অনিশ্চয়তার মেঘ নেমে আসে… বিকেল ফুরিয়ে আসছিল। এবার ওদের ভাঙা চাল বেয়ে জোছনা নামবে। আমাদের ফিরতে হবে। মিষ্টির প্যাকেটটা হাতে দিলাম। কিছুতেই নিতে চাইছিলেন না।

“আত্মসম্মানে লাগে। আমরা যে কিছু দিতে পারি না।”

সেদিন ওঁর ছেলের হাতে মিষ্টিটা দিয়ে এসেছিলাম। ফেরার পথে ভাবছিলাম। জল-কাদার রাস্তা, ঘরে আলো নেই, পেটে ভাত নেই, প্রতিভা আছে, প্রাপ্য সম্মান নেই। তবু ক্ষোভ নেই। কোনও অভিযোগ নেই। ভালবাসা দিয়ে জীবনটা ভরিয়ে রেখেছেন। মাটির কাছাকাছি থাকেন বলেই হয়তো পারেন। অচেনা চারটে মানুষকে এভাবে আপন করে নিতে।

এত কিছু দিয়েও নির্দ্বিধায় বলতে পারেন-

“কিছুই তো দিতে পারি না”।

শিল্পী বোধহয় এঁদেরই বলে…

“Art washes away from the soul the dust of everyday life”

(সে সময় আমার কাছে দামি ফোন বা ক্যামেরা কোনটাই ছিল না। তাই ছবিগুলো মনের ক্যামেরাতেই ধরে রেখেছিলাম। উপরের ছবিগুলি বন্ধুর কাছ থেকে সংগৃহীত)

ছবি ঋণ- সোহম চৌধুরী, সুপ্রিয় সরদার

Related posts

গৌড়ীয় নৃত্য দিবসে পুনর্জন্মের কিছু কথা

ক্যানভাস নিউজ

মঞ্চে নৃত্য চলাকালীন বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে মৃত্যু নৃত্যশিল্পীর

ক্যানভাস নিউজ