ক্যানভাস নিউজ
Image default
থিয়েটার

সাজানো বাগান ফেলে রেখেই বিদায় নিলেন বাঞ্ছারাম

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ ২০২৪ এর আকাশ আরও এক নক্ষত্র পতনের সাক্ষী রইল। প্রয়াত হলেন মনোজ মিত্র।
দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন এই দাপুটে অভিনেতা, যিনি ১২ নভেম্বর মঙ্গলবার সকাল ৮:৫০ নাগাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ৩ নভেম্বর বুকে ব্যাথা ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে সল্টলেকের ক্যালকাটা হার্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন মনোজ মিত্র। আর ফিরে আসা হলো না। তাঁর মৃত্যুতে বাংলা সংস্কৃতির জগতে এক বিরাট শূন্যতা তৈরি হলো। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।


১৯৩৮ সালের ২২ ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতের সাতক্ষিরা জেলার ধূলিহর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে দর্শনে অনার্সসহ স্নাতক সম্পন্ন করেন। এখানেই থিয়েটারে তাঁর পথচলা শুরু, যেখানে তিনি সতীর্থ হিসেবে পেয়েছিলেন বাদল সরকার, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে এমএ করার পর, তিনি ডক্টরেটের জন্য গবেষণাও শুরু করেছিলেন।
তাঁর নাট্যজীবন শুরু হয়েছিল ১৯৫৯ সালে তাঁর প্রথম নাটক ‘মৃত্যুর চোখে জল’ লেখা দিয়ে। ১৯৭২ সালে ‘চাক ভাঙা মধু’ নাটকটি সবার নজর কাড়ে এবং এটি দিয়ে তিনি নাট্যবিশ্বে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। মনোজ মিত্র ছিলেন নাট্যগোষ্ঠী ‘সুন্দরম’ প্রতিষ্ঠাতা, যা বাংলা নাট্যকলার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগের অধ্যক্ষ হিসেবেও কর্মরত ছিলেন এবং বিভিন্ন কলেজে দর্শন বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। একসময় পশ্চিমবঙ্গ নাট্য একাডেমির দায়িত্বও পেয়েছিলেন।


সাজানো বাগান, চোখে আঙ্গুল দাদা , কালবিহঙ্গো, পরবাস , অলোকানন্দর পুত্র কন্যা, নরক গুলজার , অশ্বথামা , চকভাঙ্গা মধু , মেষ ও রাখশ , নয়শো ভোজ , ছায়ার প্রশাদ , দেশ্বরম , শ্বরপদ্ম প্রভৃতি শতাধিক নাটক তিনি লিখেছেন। এছাড়াও রয়েছে মুন্নি ও সাত চৌকিদা , রেঞ্জার হাট , জা নে ভারতে, যদিও এই নাটকগুলির বেশিরভাগই সুন্দরম, বহুরূপী প্রভৃতি দ্বারা প্রযোজনা করা হয়েছিল।
চলচ্চিত্রেও সফল ছিলেন মনোজ মিত্র। ১৯৭৯ সালে তিনি চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন। সত্যজিৎ রায়, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, তপন সিনহা, তরুণ মজুমদার, শক্তি সামন্ত, গৌতম ঘোষের মতো পরিচালকদের পরিচালনায় অভিনয় করেছেন। তরুণ মজুমদার পরিচালিত ‘গণদেবতা’, কিংবদন্তি পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের পরিচালনায় ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’, মৃণাল সেনের ‘খারিজ’-এর মতো সিনেমায় অভিনয় করেছেন মনোজ মিত্র। সত্যজিৎ রায়ের ‘ঘরে বাইরে’ এবং ‘গণশত্রু’র মতো ছবিতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। তাঁর অভিনয়ের নৈপুণ্যে তিনি বহু দর্শকের হৃদয়ে স্থান পেয়েছিলেন। ‘বাঞ্ছারামার বাগান’ এবং ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ এ তাঁর অভিনয় প্রশংসিত হয়েছিল।


তাঁর মৃত্যুতে সংস্কৃতি জগতে শোকে ছায়া নেমে এসেছে। মেঘনাদ ভট্টাচার্য বলেন, রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা থিয়েটারকে যে তিনজন বাংলা নাটক কে সমৃদ্ধ করেছেন তার মধ্যে মনোজ মিত্র অন্যতম। বহু মৌলিক নাটক লিখেছেন। দেবেশ চট্টোপাধ্যায় বলেন, অভিভাবক হীন হলাম। অধিকারী কৌশিক বলেন, তাঁর লেখা নাটক করেননি এরকম নাট্যদল খুঁজে পাওয়া মুশকিল। চলচিত্র থেকে মঞ্চ সবেতেই রাজকীয় বিচরণ তাঁর। ওনাকে প্রথম দেখি ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ ধারাবাহিকে। মিনার্ভাতে তখন হৈ হৈ করে তাঁর লেখা ‘দেবী সর্পমস্তা’ চলছে। দেওয়ানের চরিত্রটি করতাম। উনি আলাদা করে ডেকেছিলেন আমাকে। কি বলেছিলেন আজ না হয় নাই বললাম। অসীম শ্রদ্ধা জানাই। যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন স্যার। অশোক মুখোপাধ্যায় বলেন, বন্ধু হারালাম। মনোজ খোলা মনের মানুষ ছিল। ওর কৌতুক বোধ সাংঘাতিক।


নিজের কর্মজীবনে একাধিক পুরস্কার ও সম্মান পেয়েছেন মনোজ মিত্র। যার মধ্যে রয়েছে শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের জন্য সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার (১৯৮৫), সেরা নাট্যকারের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পুরস্কার (১৯৮৬), শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের জন্য পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার পুরস্কার (১৯৮৩ এবং ১৯৮৯), এশিয়াটিক সোসাইটির স্বর্ণপদক (২০০৫), শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জন্য ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পূর্ব (১৯৮০), বাংলাদেশ থিয়েটার সোসাইটি থেকে মুনীর চৌধুরী পুরস্কার (২০১১), দীনবন্ধু পুরস্কার (২৫ মে ২০১২) এছাড়াও পেয়েছেন কালাকার পুরস্কার।
মনোজ মিত্রের মৃত্যু বাংলা সংস্কৃতি, থিয়েটার ও চলচ্চিত্র জগতের জন্য একটি বিরাট ক্ষতি। তাঁর অভূতপূর্ব অবদান আজীবন স্মরণীয় থাকবে।

Related posts

বেহালা ব্রাত্যজনের নাট্য সন্ধ্যা

ক্যানভাস নিউজ

মহিষাদলের স্বপ্নপূরণ

ক্যানভাস নিউজ

ময়না অন্য ভাবনার প্রতি মাসে অন্তরঙ্গ থিয়েটার

ক্যানভাস নিউজ