দেবাশিষ সরকার: যদি ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সৎ হয় নিষ্ঠার সাথে শ্রম হয় লক্ষ যদি অবিচল থাকে তাহলে সফলতা নবীন প্রবীণের গন্ডি পেরিয়ে সার্বজনীন স্বীকৃতি স্তরে উন্নীত হয়। বর্ধমান ময়না অন্যভাবনার নবতম প্রযােজনা ‘ভৌতিক’ নাটক তেমনই এক দৃষ্টান্তের উজ্জ্বল সাক্ষীবহনকারী। থিয়েটার জগতের প্রখ্যাত নাট্যকার সৌমিত্র বসু রচিত ও নবাগত তরুন পরিচালক স্বরাজ ঘােষের প্রয়ােগ পরিকল্পনায় এই ‘ভৌতিক ‘ নাটক এক কথায় অনবদ্য – চিরকালীন সমপােযােগি।

আমরা যারা নিজেদেরকে মানুষ বলে দাবী করি – জীব জগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবী রাখি, জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে পবিত্র অন্তরাত্নায় তাদের প্রতিবিম্ব কি যথার্থ মনুষ্যস্বরুপ প্রতিফলিত হয় ? বােধ হয় – না । আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অপূর্ণতা, আশা- আকাঙ্খা, লােভ-লালসার বশবর্তী হয়ে নিজেদের মনুষত্ব্য -বিবেককে জলাঞ্জলি দিয়ে পাশবিক প্রবৃত্তিকে নিজের মধ্যে আবদ্ধ করে নিজেদের অজান্তেই নিজেদেরকে রক্ত মাংসহীন কঙ্কালসার ভূতে পরিনত করি । যার কোন বােধ নেই, ভালবাসা নেই, মানবিকতা নেই, শুধুমাত্র সীমাহীন ভােগ বিলাসের অসার যন্ত্রবৎ পরাকাষ্ঠায় নিমগ্ন , আর অন্যদিকে একটা সত্যিকারের ভূত – সে অদম্য প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে বেঁচে ওঠার ,আর একবার মৃত্যুবরণ করে সে ফিরে আসতে চায় ঈস্বরীয় সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ কীর্তিমান মানুষ হয়ে । আর এখানেই এই নাটকের চরম স্বার্থকতা। যা দেশ কাল সীমানার গন্ডি পেরিয়ে মানব মনে চিরকালীন স্বাক্ষর রেখে যায়।নিঃসন্দেহে এই নাটক পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের বুকে স্বল্প দৈর্ঘ্য নাট্য জগতে একটি উর্বর সম্পদ। ভৌতিক নাট্য নির্মানে পরিচালক স্বরাজ ঘােষের সৃষ্টিশীল দক্ষতার গুণে নাট্য উপস্থাপনা দর্শকমনকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। নাটকের আবহ রচনা করেছেন টুটু বন্দ্যোপাধ্যায়, যা নাটককে যথাযথ সংগত দিয়েছে। নাটকের মঞ্চ নির্মাণে উদ্ভাবনী মেধার পরিচয় ঘটে। নাটকের ভৌতিক পরিবেশ রচনার ক্ষেত্রে দর্শক মনকে পুলকিত করে তােলে। এবং এই নাটকে আলাের ব্যাবহার ও তার নিয়ন্ত্রণ ভৌতিক নামের সাথে সম্পৃত্ত এবং সম্পূর্ণ মৌলিকতার দাবী রাখে। সর্বপরি নাটকের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয় এই নাটককে পরিপূর্ণভাবে স্বার্থক করে তােলে। বিষেশতঃ ভূত চরিত্রে সুকান্ত ব্যানার্জী’র মুগ্ধকরা অভিনয় ও তার আঙ্গিক অভিব্যাক্তি এই চরিত্রকে বিশ্বাসযােগ্য করে তুলেছে। এছাড়া রণ চরিত্রে সমীরণ ভট্টাচাৰ্য্য’র দৈত্ব অভিনয় চরিত্রানুযায়ী সাবলীল ও বলিষ্ঠ। মনাই চরিত্রে মৌমিতা সিংহের গলায় ‘যে রাতে মাের দূয়ার গুলি ভাঙলাে ঝড়ে’ গানটি নাটকটিকে যেন প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে তােলে। মৌমিতার অভিনয় যেমন সাবলীল তেমন গতিময়। এবং নাটকের আর একটি চরিত্রে অঙ্কন মুখার্জী’র শারীরিক অঙ্গসঞ্চালনা ও অন্তিম দৃশ্যে তার উপস্থিতি দর্শককে বিমােহিত করে নাট্য উপস্থাপনার যবনিকা নেমে আসে।

একটি ভালাে নাটক দর্শককে যেমন ভাবায়। ঠিক তেমন কাঁদায়। সমাজে নাটকের গুরুত্ব অপরিসীম। আর সেটা যদি ময়না অন্যভাবনার ‘ভৌতিক’ নাটক হয়, তবে তা সমাজ সংশােধক হিসাবে কাজ করে। আর এখানেই নাটকের চিরন্তন বিজয় পতকা মানবত্মায় অক্ষয় অমর হয়ে থাকবে।