মন্দিরা ঘোষ: পৌষের কাছাকাছি রোদমাখা সেই দুটো দিন! প্রগতির এবারের নাট্যোৎসবের রেশ থেকে বেরিয়ে আসতে মাঝে আরও একটা দিন কেটে গেছে। প্রসেনিয়াম থিয়েটারের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে কোম্নগরে গঙ্গার ধারে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাগানবাড়ির মুক্তাঙ্গনে নাটক… বসার জন্য চেয়ার নেই, মাটিতে আসন পেতে দেওয়া হয়েছে, আর রয়েছে গাছ ঘিরে বেদী… লাইট- সাউণ্ড কিছু নেই… নেই ভারী ভারী নাম…। উৎসব শুরু হলো অবন ঠাকুরের আবক্ষ মূর্তিতে মাল্যদান আর যে কাঁঠাল গাছের নীচে বসে অবনীন্দ্রনাথ প্রথম বার কুঁড়ে ঘর প্রত্যক্ষ করেন এবং রেখায় ফুটিয়ে তোলেন সেই গাছের গোড়ায় মাটি, জল দিয়ে।
৫ ও ৬ ডিসেম্বর নাট্যোৎসবের উদ্বোধক ছিলেন বিশিষ্ট নাট্যজন প্রকাশ ভট্টাচার্য্য, অদ্রিজা দাশগুপ্ত, আশিস দাস, নীলাভ চট্টপাধ্যায়, মায়া ঘোষ এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন কোন্নগর পুরসভার প্রশাসক প্রধান বাপ্পাদিত্য চ্যাটার্জি সহ আরও অনেকে। প্রথমদিন তো চারটে নাটক, নারীর মঞ্চ, চারটেই একক অভিনয়… কাকেই বা আগে রাখবো, আর, কাকেই বা পরে রাখবো! ‘ মায়ার কথকতা’ র সাতাত্তর বছর বয়সী বর্ষীয়ান মায়া ঘোষ এর দাপট, না, ‘ YES ‘ এর মিষ্টি চেহারার বাচ্চা মেয়েটি, ভূমিসূতা দাস , কতো বয়স হবে? চব্বিশ? পঁচিশ? কি বলিষ্ঠ অভিনয়! আর… ঋতুপর্ণা বিশ্বাস এর ‘ সাবিত্রী বাঈ ফুলে ‘? আমাদের কি একবার ও মনে হয়েছে, উনি একাই বাবা, মা, স্বামী, স্ত্রী, সন্তান, প্রতিবেশী সবার চরিত্রেই অভিনয় করে যাচ্ছেন! কজন জানতাম সেভাবে সাবিত্রী বাঈ ফুলের কথা! এক ঘন্টা তিরিশ মিনিটের একক অভিনয়ের শেষ দৃশ্যে আমাদের সবার চোখে জল! তারপরেও দেখা বাকি ছিলো! সঞ্জিতার ‘ শীতলপাটি ‘। মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখেছি, আর, সঞ্জিতা কে একবারের জন্যেও নাটকের ‘ হাজু ‘ ছাড়া কিছু ভাবতেই পারিনি!
প্রথম দিনের রেশ কাটতে না কাটতেই পরের দিন। প্রগতির নিজস্ব দুটো নাটক ছাড়াও ছিলো আরও তিনটে নাটক। ‘ এসো নাটক শিখি ‘ র ‘একটি মাঠের জন্য ‘ তে বাচ্চাদের জড়তাহীন, প্রাণবন্ত অভিনয়,’ হাতিবাগান সংঘারাম ‘ এর ‘রথযাত্রা ‘য় রবীন্দ্রনাথের গল্পকে ভেঙে আজকের কৃষক আন্দোলনের সাথে মিশিয়ে দিয়ে তাদের দলের সুনাম রক্ষা করেছে। আর, বিসর্গ থিয়েটারে’র ‘কৌটো’? ওরা বলে নাটকের হোম ডেলিভারি। সামান্য উপকরণে ওরা নাটক নিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ… নাটককে পৌঁছে দিচ্ছে মানুষের বাড়ির আঙিনায়। সব শেষে যখন ধামসা মাদলের তালে বিসর্জনের বাজনা বেজে উঠলো, মনে হলো, এতো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলো! মশালের আলোগুলো যাতে আরও কিছুক্ষণ জ্বালিয়ে রাখা যায়, তার জন্য আবীর, শংকর, রাজুদের কি প্রচেষ্টা! মনে হচ্ছিলো, নিভন্ত ওই মশালে একটু আগুন দে, আর একটু কাল বেঁচেই থাকি বাঁচার আনন্দে। এই আলো তো নিভতে দেওয়া যাবে না… এই আলো জ্বলুক আমাদের সবার মুখে.., সব নাট্যকর্মীদের মুখে…।