শিল্পই হল শান্তি
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ ২০২৪ সালে বিশ্ব নাট্য দিবস উপলক্ষে চিনের লংফাং শহরে ২৭ মার্চ থেকে ২৯ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে বিশ্ব নাট্য দিবসের অনুষ্ঠান। ১৯৬১ সাল থেকে বিশ্ব নাট্য সংস্থা ২৭ মার্চ বিশ্ব নাট্য দিবস উপলক্ষে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের জনপ্রিয় কোন না কোন নাট্যশিল্পীকে থিয়েটার সম্পর্কে একটি বার্তা লিখতে বলে। ২০২৪ এ বিশ্ব নাট্য দিবসের বাণী লিখেছেন নরওয়ের নাট্যকার ও সাহিত্যিক জন ফোসে। বাংলায় অনুবাদ করেছেন নাট্যশিল্পী ও লেখক মলয় ঘোষ।
বিশ্ব নাট্য দিবসের বাণীঃ
প্রত্যেক ব্যক্তিই অনন্য এবং প্রত্যেকেই প্রত্যেকের মতই স্বতন্ত্র। আমাদের বাহ্যিক চেহারা ও আচরণ অন্য সবার থেকে স্বভাবতই আলাদা। এটাই স্বাভাবিক এবং পরিচিত আমাদের কাছে। তবে আমাদের প্রত্যেকের ভিতরেও এমন কিছু আছে যা আমাদের প্রত্যেকের একার। এই ‘একাকিত্ব’ই হল আমাদের প্রত্যেকের স্বাতন্ত্র্য। এটাই আমাদের আত্মা, এই আমাদের শক্তি।
ব্যক্তির একা যা, তাই ব্যক্তির একক।
এটিকে আমরা কথায় বা সীমায় বাঁধতে পারি না। এটিকে আমরা একা একাই ছেড়ে দিতে চাই একান্তে।
কিন্তু আমরা সবাই একে অপরের থেকে আলাদা হলেও আমাদের মধ্যে কোথাও যেন একটা মিলও আছে। বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের মানুষ মৌলিকভাবে অনেকটা একই রকম। সে বিভিন্ন মানুষ কী ভাষায় কথা বলছে, কী ধরনের ত্বক বা চুলের রঙ তাদের… এই সব অনুষঙ্গের উপর তাদের এই মিল নির্ভর করে না।
হতে পারে একজন ব্যক্তি অভ্যন্তরীণভাবে স্বতন্ত্র, দেহ এবং আত্মার সেতুবন্ধনে বা পার্থিব জগতের চাহিদার নিরিখে মানুষ অনেক সময়ই একে অপরের সঙ্গে ভিন্নতর হয়ে ওঠে।
শিল্পই সর্বজনীনের সাথে সম্পূর্ণ অনন্যকে একত্রিত করতে পারে, মেলাতে পারে। শিল্পই বুঝতে দেয় কোনটা আলাদা, কোনটা নিজস্ব, কোনটি আরোপিত… এই অনুভব থেকেই একটি অনন্য মানুষ তার ভাষা, তার ভৌগলিক সীমানা, তার স্থান, কাল পাত্রকে ভেঙে রূপ থেকে অরূপের ডাকে সাড়া দিতে পারে, সীমা থেকে অসীমের কোলে বিচরণ করতে পারে। সমস্ত বৈচিত্রকে অতিক্রম করে আপন আপন স্বাতন্ত্র্য ও অনন্যতাকে নিয়ে মানুষ এভাবেই গড়ে তোলা সমগ্র এক জাতিসত্ত্বা।
সমস্ত পার্থক্যকে দূর করে সমস্ত কিছুকে এক করে দেওয়াই কিন্তু শিল্পের মূল কাজ নয়। শিল্পই সঠিকার্থে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে
আমরা আমাদের থেকে কী কী বিষয়ে আলাদা। প্রকৃত শিল্পই সুনির্দিষ্টভাবেই বুঝিয়ে দিতে পারে কী আমাদের নিজস্ব, কোনটা অপরের, কী আমাদের গ্রহণীয়। মনে রাখতে হবে প্রকৃত শিল্পকে আমরা সম্পূর্ণভাবে বুঝতে নাও পারি, কিন্তু সামগ্রিকভাবে তা আমাদের একটি উপলব্ধির পথে নিয়ে যায়, আর তাই আমাদের মানবিক উৎকর্ষের দিকে পরিচালিত করে।
এর চেয়ে ভাল পথ আর কিছু নেই এ বিশ্বে।
আর এর বিপরীতে আছে যা আছে তা হল সংকীর্ণতা, দ্বন্দ্ব, সন্ত্রাস, ধ্বংস ও যুদ্ধের বাতাবরণ। আর এই সবের মূলে আছে কিছু অমানবিক কার্যাবলী, বস্তুবাদী প্রযুক্তির থাবা এবং কিছু মানুষের পাশবিক প্রবৃত্তি।
মানুষের শুভ’র জন্য তাই এই সব প্রবৃত্তিতাড়িত কার্যাবলী, এককের স্বাতন্ত্র্য একটি বিরূপ হুমকির মত। আর এই মননের প্রকৃত নির্মূল প্রয়োজন । ধর্ম বা রাজনৈতিক মতাদর্শের মধ্যে অনেক সময় একটা অনৈক্য ও পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই অনৈক্যকে পরাজিত এবং ধ্বংস করতে হবে।
সমস্ত শিল্পের গভীরে যা লুকিয়ে আছে তা হল সমস্ত অমঙ্গলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। আমাদের মধ্যে যে মিথ্যা তাকে চিরতরে বিনষ্ট করতে পারে একমাত্র শিল্প।
আমি এখানে থিয়েটার বা নাট্যরচনার বিষয়ে বিশেষ করে কিছু বলিনি, কারণ আমি বিশ্বাস করি সমস্ত ধরণের শিল্পের বিশিষ্টতা নাট্যের মধ্যে আছে। তাই আমি সাধারণভাবে এখানে শিল্পের কথাই বলেছি।
প্রকৃত শিল্পই পারে শৈল্পিকভাবে সমস্ত অসাম্য, অসামঞ্জস্য এবং অমঙ্গলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সত্য ও সুন্দরকে বিশ্বজনীন করে তুলতে।
আর এখানেই দেশ বিদেশের সমস্ত অমিল ও মালিন্য ঘুঁচে গিয়ে এক অভাবনীয় ঐক্য গড়ে ওঠে।
যুদ্ধ এবং শিল্প পরস্পর বিপরীতধর্মী যেমন যুদ্ধ এবং শান্তি চিরকাল যুদ্ধ করে এসেছে একে অপরের বিরুদ্ধে। তবে সবশেষে একটাই সিদ্ধান্তে আমরা আসতে পারি, শিল্পই শান্তির একমাত্র পথ, অন্যভাবে বলা যায় প্রকৃতার্থে শিল্পই শান্তি আর শান্তিই শিল্প।